এগারো মাস আগের কথা! পারিবারিকভাবে বিয়ের পর সংসার সাজানো শুরু করেন আসাদ ও নুরানী খাতুন। অর্থনৈতিক দুরাবস্থায় ভাগ্য বদলাতে রাজধানী ঢাকায় পাড়ি জমাতে হয় তাদের। নতুন বউকে নিয়ে আসাদ ভাড়া বাসায় উঠেন। উত্তরার দক্ষিণখান মাজার রোডে শুরু হয় নতুন দম্পতির স্বপ্ন যাত্রা। স্বল্প শিক্ষিত আসাদ শুরু করেন ভাড়ায় লেগুনা (ছোট ট্রাক) চালানো। গল্পটা শেরপুরের আসাদুল্লাহ (২৫) এবং তার স্ত্রী মোছা. নুরানি খাতুন (২০) এর। সময়ের সাথে নতুন অতিথি আসার অপেক্ষা শুরু হয় তাদের।
নুরানী এখন আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা। স্ত্রীকে ভালো রাখা আর নতুন অতিথির অপেক্ষায় থাকা আসাদের স্বপ্ন যাত্রা এভাবে থেমে যাবে, ভাবেনি কেউই। গেলো ১৮জুলাই সহিংসতায় আঁধার নেমেছে নতুন সংসারে; অন্তঃসত্ত্বা নুরানীর চোখে মুখে রাজ্যের অন্ধকার। শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার গড়জরিপা ইউনিয়নের পশ্চিম চাউলিয়া গ্রামের জয়নুদ্দীনের ছেলে আসাদ উত্তরার আজমপুর কাঁচাবাজারে সহিংসতা চলাকালে গুলিবিদ্ধ হন। স্থানীয়রা উদ্ধার করে উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালে নিয়ে গেলে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।
প্রতিদিনের মতো নিয়ম করে আসাদ সেদিনও বেরিয়েছিলেন কাজে। ১৮জুলাই দুপুরের খাবারের পর লেগুনা নিয়ে বাসা থেকে বের হন তিনি। এরপর তার নিথর দেহ ফেরে তার গ্রামের বাড়িতে। তার জানাজার সাথে পুরো পরিবারের স্বপ্নও যেন মাটি চাপা পড়ে গেছে। নিস্তব্ধ আর্তনাদ আর হাহাকারে ভারী হয়েছে পুরো বাড়ি। অন্তঃসত্ত্বা নুরানীর হাস্যোজ্জ্বল মুখ এখন মলিন। স্বামী হারানোর কষ্ট আর সন্তানের ভবিষ্যতের চিন্তায় কাবু হয়ে নির্বাক তিনি।
নিহত আসাদুল্লাহর স্ত্রী নুরানি খাতুন বলেন, ‘আমার জামাই ড্রাইভার, লেগুনা চালাইতো। এই আন্দোলন সম্পর্কে কিছুই জানে না। প্রত্যেক দিন বাসা থেকে গাড়ি নিয়ে বাইর হত, সারাদিন গাড়ি চালাইয়া বাসায় আসতো। কারও সঙ্গেই তেমন মিসত না। হঠাৎ করেই আমার জামাই মইরা যাইব জানলে আমি ওইদিন বাইর হইতে দিতাম না। আমার আট মাসের বাচ্চা পেটে, কই দিন পরই বাচ্চা হইবো। এহন ওই (আসাদুল্লাহ) মইরা গেল। আমার সন্তানকে কে দেখবো। আমরা জামাই কোনো পক্ষের ছিল না, ওই গাড়ি চালাইতো। কিছু দিন পর আমার বাচ্চা হইবো, ওর বাপ দুনিয়ায় নাই, কারে বাপ ডাকব? আমি কেমনে মানুষ করমু ওরে?’
আসাদুল্লাহর স্ত্রী আরও বলেন, ‘আমাদের বিয়ে হয় এগারো মাস আগে। পরিবার থেকে বিয়ে দেয়। আমার স্বামীর তো কোনো দোষ আছিলো না। এখন আমারে আর আমার বাচ্চাটাকে কে দেখবো।’
আসাদুল্লাহ বাবা জয়নুদ্দীন বলেন, ‘আমার ছেলে ঢাকার উত্তরায় থেকে লেগুনা চালাইতো। হঠাৎ করে রাস্তায় উঠছে আর ওরে গুলি করছে। দুইটা গুলি দুই হাতে আর একটা পেটের সামনে দিয়ে লেগে পেছন দিয়ে বের হয়ে গেছে। আরেকটা নাভির নিচে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার পোলা কোনো পক্ষ আছিল না। আমাদের নিজের কোনো বাড়ি নাই, তাই পুলাডা ঢাকা থাকতো। পোলার বউয়ের আট মাসের বাচ্চা পেটে, কইদিন পর বাচ্চা হবে। আর এহন আমার পোলা নাই। আমার একটাই পোলা আছিলো। চার সদস্যের পরিবার ছিল আমাদের, কিন্তু এখন পোলাডাই নাই।’
স্থানীয় সুরুজ আলী বলেন, ‘বৃহস্পতিবার আমাদের কাছে ফোন আসে আসাদুল্লাহ গুলি খেয়ে মারা গেছে। আমরা বিশ্বাস করতে পারি নাই। ওই আমাদের এলাকার ভাইস্তা (ভাতিজা)। বিয়ের পর থেকে ঢাকায় লেগুনা চালাইতো। লেখাপড়া কোনোমতে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়ছে, আন্দোলন কি জানে না। পেটের ভাত জোগাড়ে গাড়ি চালাইতো। বছরখানেক আগে গ্রামে বিয়ে করে বউ নিয়ে ঢাকা গিয়েছিল, এখন লাশ হয়ে আইলো। ওর বউ আট মাসের গর্ভবতী বাচ্চার মুখটাও দেখা যেতে পারল না আসাদুল্লাহ।’
গড়জরিপা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল বলেন, আসাদুল্লাহ লেগুনা গাড়ি চালাইতো ঢাকায়। আন্দোলন চলাকালে গুলিতে মারা গেছে। আমি খবর পেয়ে ওর জানাজায় গিয়েছি, পরে এলাকার লোকজনসহ তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। ওর স্ত্রী আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা। আমি জানিয়েছি ওর স্ত্রী গর্ভবতী কার্ডসহ যে সুযোগ-সুবিধাগুলো দেওয়া যায় আমি দেব। তাদের যেকোনো সহযোগিতায় আমি পাশে আছি।
শ্রীবরদী থানা পুলিশের অফিসার ইনচার্জ কাইয়ুম খান সিদ্দিকী বলেন, গত ১৯ জুলাই আমরা ঢাকা থেকে গড়জরিপা ইউনিয়নের চাউলিয়া গ্রামে দুইটি মরদেহ আসার সংবাদ পাই। পরে টিম পাঠিয়ে তাদের তথ্য নিয়েছি।