বৃহস্পতিবার, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২৪

তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে নিবন্ধনের জন্য আবেদিত

শেখ রাসেল বিশ্ববিদ্যালয় শেরপুরে কেন প্রয়োজন

সৌমিত্র শেখর

এক অ্যাপেই সব চাকরি ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি

সৌমিত্র শেখর

শেরপুরের পরিচয় ও গর্ব

ময়মনসিংহ বিভাগের উত্তরে সীমান্তবর্তী প্রান্তিক জেলা শেরপুর। কিন্তু ব্রিটিশদের কাছে উন্নয়নের নানা মাত্রায় শেরপুর আর ময়মনসিংহ একদিন সমকাতারে ছিল। কৃষিনির্ভর অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বিস্তীর্ণ শস্যক্ষেত্র ও নিরুপদ্রব শস্যসংগ্রহে শেরপুর ছিল ঈর্ষণীয় এক জনপদ। তাই ১৮৬৯ সালে ময়মনসিংহ ও শেরপুর দুটো শহরকেই মিউনিসিপ্যালটি ঘোষণা করে ইংরেজরা। শেরপুরের সংস্কৃতিবান্ধব জমিদার হরচন্দ্র রায়চৌধুরীর পৃষ্ঠপোষকতায় ১৮৬৫ সালে গঠিত হয় ‘বিদ্যোন্নতি সভা’ নামের একটি সংগঠন। যে সংগঠন শুধু সাহিত্যই নয়, পাঠাগার বিস্তৃতি, সংস্কৃতিচর্চা ইত্যাদিতেও ভূমিকা রাখে। ‘বিদ্যোন্নতি সাধিনী’ (১৮৬৫) নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করার ব্যবস্থা হয় এবং এর সম্পাদক ছিলেন বিশিষ্ট পণ্ডিত মহামহোপাধ্যায় চন্দ্রকান্ত তর্কালঙ্কার। বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে এটিই প্রথম পত্রিকা। এই পত্রিকা ছেপে আনা হতো মূলত কলকাতা থেকে।

হরচন্দ্র রায়চৌধুরী ১৮৮০ সালে নিজের তত্ত্বাবধানে শেরপুরে ‘চারুযন্ত্র’ (প্রেস) নামে ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেখান থেকেই একই বছর তার নিজের সম্পাদনায় ‘সাপ্তাহিক চারুবার্তা’ নামে পত্রিকা প্রকাশ পায়। তখন রংপুর, ঢাকা, যশোর, কুষ্টিয়া ছাড়া পূর্ববঙ্গে কোনো ছাপাখানা ছিল না। যশোরের ‘অমৃত প্রবাহিণী যন্ত্র’টি (প্রেস) আবার ছিল কাঠের তৈরি। বিলেত থেকে আনা অপেক্ষাকৃত আধুনিক মুদ্রণযন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায় শেরপুরে। ভাই গিরিশচন্দ্র সেন তখন কর্মসূত্রে ময়মনসিংহে। ১৮৮১ সালে কোরআন শরিফ বাংলায় প্রথম অনুবাদ করে সেটি প্রকাশের জন্য তিনি শেরপুর আসেন এবং চারুযন্ত্র (প্রেস) থেকে তা প্রথম ছাপা হয়। টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার এস্টেটে কর্মরত মীর মশাররফ হোসেন ‘বিষাদ-সিন্ধু’ নিয়ে আসেন শেরপুরে। ১৮৮৫ সালে ‘চারুযন্ত্র’ থেকে প্রকাশ পায় ‘বিষাদ-সিন্ধু’র প্রথম খণ্ড ‘মহরম পর্ব’।

উনিশ শতকের পঞ্চাশের দশকে ময়মনসিংহের প্রথম বিদ্যালয় স্থাপনের (১৮৫৩) সঙ্গে শেরপুরের জমিদার হরচন্দ্রও একটি ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যেটিকে ১৮৮৭ সালে ‘ভিক্টোরিয়া একাডেমি’ নামকরণ করে সাধারণ হাইস্কুলে উন্নীত করা হয়। উনিশ শতকের মধ্যভাগে শেরপুরে প্রতিষ্ঠিত ‘হেমাঙ্গ লাইব্রেরি’ বৃহত্তর ময়মনসিংহ এলাকায় ছিল উল্লেখযোগ্য। পাঁচশ বছরের পুরোনো পুথি থেকে সাম্প্রতিক গ্রন্থ সবই ছিল সেখানে। ১৮৮৩ সালে ময়মনসিংহে টেলিগ্রাফ স্থাপিত হয়, শেরপুরে তা সম্প্রসারিত হয় মাত্র দু বছরের মধ্যে, ১৮৮৫ সালে। ভারতবর্ষের প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলন বলতে সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহেকে ধরা হয়। ১৭৫৭ সালের পলাশী যুদ্ধের পর মিরজাফর ক্ষমতাগ্রহণ করে খাজনা তোলার ভার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে অর্পণ করলে প্রথমে ১৭৬০ সালের সন্ন্যাসীরা বিদ্রোহ করেন এবং ১৭৭১ সালে বিদ্রোহ করেন ফকিররা। এই বিদ্রোহ দুটো হয়েছিল শেরপুর অঞ্চলেও।

তাছাড়া পাকিস্তান শাসনামল আরম্ভ হলে ১৯৪৯ সালের নানকার বিদ্রোহে শরিক হয় শেরপুরের মানুষ এবং ১৯৫০ সালের টঙ্ক প্রথাবিরোধী আন্দোলনে শেরপুরের গণমানুষের ব্যাপক অংশগ্রহণ আজ ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে। কিন্তু পাকিস্তান আমল থেকেই শেরপুর প্রশাসনিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে থাকে। উপরন্তু ব্রহ্মপুত্র নদের উত্তর দিকে সীমান্তবর্তী অবস্থানের কারণে যোগাযোগের ব্যবস্থা আধুনিকীকরণের দিকে প্রশাসন উদ্যোগ গ্রহণ করে না। তাই যে শেরপুর একদিন অর্থনীতি, সাহিত্য, সংস্কৃতি, জীবনাচার, প্রশাসন, আন্দোলন-বিদ্রোহে ময়মনসিংহের সঙ্গে সমান তালের জনপদ ছিল এবং ক্ষেত্র বিশেষে অগ্রসর ছিল– মাত্র একশ বছরের কম সময়ের মধ্যে ময়মনসিংহ থেকে শেরপুরের সার্বিক পার্থক্য আকাশ-পাতাল হয়েছে এবং শেরপুর যেন গভীরতর অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে বসেছে।

শেরপুরে কেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রয়োজন

কোনো প্রতিযোগিতার তুলনা নয়, বুঝবার সুবিধার জন্য আমরা শুধু শিক্ষাক্ষেত্রের দৃষ্টান্তই দিতে চাই: যে ময়মনসিংহ আর শেরপুর ছিল একদিন সমানতালে অগ্রবর্তী, সেই ময়মনসিংহে আজ একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, একটি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়, একটি সরকারি মেডিকেল কলেজ, একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ, একটি প্রকৌশল কলেজ, দুটি শিক্ষক প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয়, একটি ক্যাডেট কলেজ, একটি শিক্ষাবোর্ড। পক্ষান্তরে শেরপুরে এর একটিও নেই। শেরপুরের ছাত্রছাত্রীদের একটু উন্নত শিক্ষা নিতে হলেও যেতে হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ময়মনসিংহের আনন্দমোহন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে অথবা মুমিনুন্নিসা সরকারি মহিলা কলেজে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ হলে সেটিও জামালপুরে বা নেত্রকোণায়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছেন (২৫ জুলাই, ২০১৫), প্রতিটি উপজেলায় সরকারি স্কুল এবং প্রতিটি জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হবে। এই ধারাবাহিকতায় ময়মনসিংহের পাশাপাশি জামালপুরে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নেত্রকোণায় শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়েছে এবং কিশোরগঞ্জে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য সংসদে বিল পাস হয়েছে। অথচ, জামালপুর, নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ কোনো জেলার চেয়েই পশ্চাৎপদ নয় বা ছিল না শেরপুর জেলা।

বর্তমান প্রশাসনের সুদৃষ্টি পেলে শেরপুর আবার পাকিস্তানপূর্ব অবস্থায় ফিরে আসতে পারে। যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্প্রসারণের কারণে শেরপুর আজ পাঁচ জেলার প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষের মিলনস্থল। যেমন, শেরপুরের পূর্বদিকের ময়মনসিংহ জেলার সীমান্তবর্তী হালুয়াঘাট উপজেলা, পশ্চিমদিকের জামালপুর জেলার বকসিগঞ্জ উপজেলা এবং তার পাশের গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রাম জেলার অনেক মানুষ আজ শেরপুরের যে-কোনো সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে। উল্লিখিত অঞ্চলের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতিসাধনের কারণে শেরপুরে যদি একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয় তাহলে সেখানে ছাত্রছাত্রীর অভাবতো হবেই না বরং পাকিস্তান আমল থেকে প্রশাসনের বৈষম্যের কারণে পিছিয়ে পড়া এই অঞ্চলের মানুষের সার্বিক উন্নয়নে বিশ্ববিদ্যালয়টি বিশল্যকরণীর কাজ করবে। আমরা বিশ্বাস করি, এখানে উচ্চশিক্ষার একটি আলোক শিখা জ্বালালেই তার প্রভাব পড়বে শেরপুরের অর্থনীতি, সংস্কৃতি, রাজনীতি, সমাজের নানাস্তরে। বর্তমান সরকার প্রান্ত থেকে উন্নয়ন কেন্দ্রমুখী নিয়ে যাওয়ার যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, শেরপুরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা সে উদ্যোগের উপাদান হিসেবে কাজ করবে।

শেখ রাসেল বিশ্ববিদ্যালয় কেন

শেরপুরে শেখ রাসেলের নামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি কেন, এই প্রশ্ন উঠতে পারে। শেখ রাসেল হলেন এমন একজন মানুষ, যিনি নিষ্পাপ, মাসুম, পবিত্রতার প্রতীক। আর উচ্চশিক্ষাতো তাই, যা মানুষকে বিশুদ্ধজ্ঞানের মাধ্যমে পবিত্র করে তোলে? নিজের কোনো অংশগ্রহণ না-থাকার পরও যে মানবশিশুটিকে রাজনীতির যূপকাষ্ঠে জীবন দিতে হলো, সেই শেখ রাসেলকে নিয়ে সমাজ বা রাজনীতির কোথাও কোনো বিতর্ক নেই। সবাই তাকে নিষ্পাপ ফুলের সঙ্গেই তুলনা করেন। এই বিকর্তহীন শুভ্র চরিত্রের মানুষটির নামেইতো বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া যথাযথ। অথচ তার নামে দেশের কোথাও কোনো বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শেরপুরে একাধিকবার গেলেও মুক্তিযুদ্ধের মহান স্থপতি ও জাতির পিতা বা তার পরিবারের কারো নামেই শেরপুরে কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। শেখ রাসেলের নামে শেরপুরে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের মাধ্যমে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে সে শুভ সূচনাও হতে পারে। আর একটি কথা, বঙ্গবন্ধু তার কনিষ্ঠপুত্রের নামকরণ করেছিলেন বিখ্যাত দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের নামে। এই প্রখ্যাত দার্শনিকের নামটিও পরোক্ষভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্মরণীয় হবে নিশ্চয়।

অতএব, প্রতিজেলায় বিশ্ববিদ্যালয়- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই ঘোষণা অনুসারেই বিভিন্ন আন্দোলন-বিদ্রোহের পীঠস্থান, ঐতিহাসিক ও সমৃদ্ধ শেরপুর জেলাতে অনতিবিলম্বে ‘শেখ রাসেল বিশ্ববিদ্যালয়’ স্থাপন করা প্রয়োজন। আশাকরি, সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।

লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং চেয়ারম্যান, শেখ রাসেল বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন গণকমিটি, ঢাকা।

আমাদের সাথে যুক্ত হোন

106,000FansLike
3,500FollowersFollow
1,600SubscribersSubscribe

সর্বোচ্চ পঠিত

সর্বশেষ আপডেট

শেরপুর জেলার প্রথম ডিজিটাল মিডিয়া প্লাটফর্ম ও তারুণ্যের পোর্টাল শেরপুর লাইভ ২৪ ডট কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় : শেরপুরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সমস্যা ও সম্ভাবনা, ফিচার, ভ্রমণ, সাহিত্য, পর্যটন এবং কৃষি-প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন sherpurlive247@gmail.com ঠিকানায়।

২০১৭ সাল থেকে যাত্রা শুরু করা শেরপুর লাইভ - শেরপুর জেলার প্রথম ডিজিটাল মিডিয়া, প্রোডাকশন, লাইভ ব্রডকাস্ট এবং সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্ম। যাত্রালগ্ন থেকেই প্লাটফর্মটি তারুণ্যকে কাজে লাগিয়ে জেলা ব্র্যান্ডিংয়েরে কাজ করে আসছে। শেরপুরকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরতে বিভিন্ন প্রামাণ্যচিত্র, স্থিরচিত্র ও তথ্য প্রকাশের প্লাটফর্ম এটি।

Sherpurlive24.com is the first digital media platform of Sherpur District & one of the popular Bangla media news portal in Sherpur. It has begun with commitment of district branding, youth awareness, fearless, informative and independent citizen journalism. This portal has started to provide live video production & real time news updates with maximum use of modern technology from 2017. 
A genius team of Sherpur Live has been built with a group of energetic young citizen journalists. We are trying to spread Sherpur district as a famous district for its tourism sector & build a bridge with Sherpur around the world and adding a new dimension to district branding with our digital media platform SherpurLive24.com

কার্যালয় : কক্ষ নং ০৪, সাদেক ভবন (নীচ তলা)
চকবাজার, শেরপুর শহর, শেরপুর ২১০০।

মোবাইল : 01866 293 776
মেইল : sherpurlive247@gmail.com